দুই বছরেও শুরু হয়নি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

বিশেষ প্রতিবেদক :

রাখাইনের জোর পূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমের আশ্রয় প্রদানের প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও তাদের ফিরিয়ে নিতে গড়িমসি করছে মিয়ানমার। এ প্রেক্ষাপটে উভয় রাষ্ট্র পরস্পর বিরোধী বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে।

মিয়ানমার বলছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রাখাইনের জোরপূর্বক স্থানচ্যুতদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় ফেরত কার্যক্রমে বাংলাদেশ কোন সহযোগিতা করছে না। ২০১৭ সালের এ সংক্রান্ত দ্বি পক্ষীয় বলবৎ চুক্তিকেও সম্মান দেখানো হচ্ছে না।

এদিকে মিয়ানমার রাখাইনে ফিরে গিয়ে নিরাপদে,মর্যাদার সাথে নুন্যতম মৌলিক অধিকার নিয়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের মত তেমন কোন সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমার আন্তরিক নয় বলে বাংলাদেশ সহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বরং এ ব্যাপারে মিয়ানমার প্রতিনিয়ত মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম (২ জুন) লিখেছে,সম্প্রতি  জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ শীর্ষক ২৫তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির অফিস বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিইয়উ টিন্ট সুয়ে।

এতে তিনি অভিযোগ করেন, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চল থেকে যেসব মানুষ পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী হয়েছে তাদের ফেরত পাঠানো এবং আবাসিক কার্ড দেয়ার বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করছে না বাংলাদেশ। এখানেই শেষ নয়।

মিয়ানমার মন্ত্রী  আরো অভিযোগ করে বলেছেন, ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবর্তন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির প্রতি কোনোই সম্মান দেখাচ্ছে না বাংলাদেশ।
ওই চুক্তির অধীনে রোহিঙ্গা ও অন্য যেসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। ঐ মন্ত্রী  বলেন, এই প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে কোনো উদ্বাস্তু  এখন পর্যন্ত ফেরত আসেনি।তবে প্রায় ২০০ মানুষ তাদের নিজ উদ্যেগে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের দেয়া তালিকায় ১৬৮ জন নিষিদ্ধ আরসা সদস্য রোহিঙ্গা রয়েছে বলে মিয়ানমারের অভিযোগ।

তবে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, নাগরিকত্বের মতো আইনগত নিশ্চয়তা ছাড়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে তারা সেখানে অব্যাহত নির্যাতনের মুখে পড়বে, যেখানে তাদের অবাধ চলাফেরা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অধিকার দেয়া হয় না।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার যিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত উভয় দেশের গঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপেরও সদস্য মোঃ আবুল কালাম বলেন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মত সহায়ক কোন পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেনি মিয়ানমার। সর্বশেষ ৩০ হাজারের বেশী রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের নিকট হস্তান্তর করা হলেও এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের মত রোহিঙ্গার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এতে বুঝা যায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার আদৌ আন্তরিক কি না।

১ জুন সৌদি আরবের মক্কায় ১৪তম অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশান-ওআইসি সম্মেলনে এশীয় গ্রুপের পক্ষে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আইন অনুযায়ী অধিকার নিশ্চিত করতে মুসলিম বিশ্বের সহায়তা চেয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এরপরও মানবিক চিন্তা থেকে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। তবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়নি। রোহিঙ্গাদের ফেরানোর জন্য উত্তর রাখাইনে যে অনুকূল পরিবেশ থাকা দরকার, মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটি করতে পারেনি।

গত সপ্তাহে(১২ জুন) বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা সংক্রান্ত এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন  বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিথ্যাচার করছে মিয়ানমার। জাপানের ফিউচার এশিয়া সম্মেলনে মিয়ানমারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেরি হচ্ছে। এটা ডাহা মিথ্যা কথা।

তিনি বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখছে না। রাখাইনে ৮০০টি গ্রামের মধ্যে তারা মাত্র দুইটি গ্রামের পরিস্থিতি ভালো দেখিয়ে বলছে, সেখানে কোনো সমস্যা নেই।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু না হলে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে বিশ্ব, বাড়বে সন্ত্রাসী তৎপরতাও’- এমন মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের মিথ্যাচার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। গত ১০ জুনও রাশিয়ার মন্ত্রীকে মিয়ানমার স্টেট কাউন্সিলর অফিস এ সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতন শুরুর পর ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে।  ১১ জুন প্রথম বারের মত বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং ঝু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে আসেন। ক্যাম্প সফর কালে চীনের রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ একান্ত বৈঠকও করেন।

২০১৮ সালে শরণার্থীদের গঠিত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস – এআরএসপিএইচআর চেয়ারম্যান মাষ্টার মহিবুল্লাহ বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূতের মনোভাবে রোহিঙ্গারা আশাবাদী।

তিনি বলেন আমরা বুঝতে পেরেছি রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্টায় বাংলাদেশ যে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে, সেভাবে কিন্তু বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কাজ করছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের ভূমিকার বিকল্প নেই। কারণ মিয়ানমার আগাগোড়াই চীনের উপর নির্ভরশীল। এ ছাড়াও গঠিত কমিটি  মিয়ানমারের সংবিধান সংশোধনের জন্য একমত হয়েছে। ১৭ জুন কমিটি সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত প্রণীত খসড়া প্রতিবেদন  দেশটির উচ্চ কক্ষে পেশ করার কথা রয়েছে বলে ঐ রোহিঙ্গা নেতা জানান।

সুতরাং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সহ অন্যান্য অধিকার প্রতিষ্টায় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগামী মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর কালে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে রোহিঙ্গা নেতারা আশাবাদী।